
আদালত অবমাননার ঘটনায় দণ্ডপ্রাপ্ত খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে পদত্যাগই করতে হচ্ছে বলে আওয়ামী লীগদলীয় একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
রোববার রায় ঘোষণার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দেখা দেননি। প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত বলে ওই সূত্রটি জানায়।
এর আগে আদালত অবমাননার পরও এই দুই মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখনও প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে দেখা করেননি।
রোববার সকালে আদালত অবমাননা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। অনাদায়ে তাদের ৭ দিনের কারাদণ্ডেরও নির্দেশ দেওয়া হয়।
সূত্রটি বলছে, দুই মন্ত্রী যদি পদত্যাগ না করেন, তবে সোমবারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি ওঠানো হবে এবং বৈঠকে যে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে।
জানা গেছে, মন্ত্রিসভার গত বৈঠকের আগের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি তিনি এসব বিষয় নিয়ে জেনে-বুঝে ও সতর্কতার সঙ্গে কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে এক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলছেন, তারা মন্ত্রী ও আইনপ্রণেতা। কিন্তু তারা বুঝে-শুনে কথা বলবেন। তা করেননি। এ বিষয়টি সরকারের নয়। এর দায়-দায়িত্বও সরকারের নয়।
তিনি বলেন, আদালত যদি বলেন, তারা (দুই মন্ত্রী) শপথ ভঙ্গ করেছেন, তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার।
খোদ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও দুই মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যকে ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’ বলে অভিহিত করেছেন।
দুই মন্ত্রীকে আদালত সাজা দেওয়ায় তাদের মন্ত্রিত্ব থাকবে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ মুহূর্তে বলা ঠিক হবে না। সংবিধানে এ ব্যাপারে বিস্তারিত রয়েছে। তবে এটি নৈতিকতার প্রশ্ন।
তিনি আরও জানান, সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে হাবিবুল্লা খান নামে এক মন্ত্রীকে আদালত সাজা দিয়েছিলেন। সম্ভবত তখন তার মন্ত্রিত্ব যায়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আজ যে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাতে শপথ ভঙ্গের কথা বলা হয়েছে। তবে মন্ত্রিপরিষদ এর ব্যবস্থা নেবে।
এ ব্যাপারে সংবিধানেও নির্দেশনা রয়েছে। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২ এর ঘ অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনও ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যুন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে। এবং ৬৬ (২) ঙ অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না যদি তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোনও অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইয়া থাকেন।
সূত্র জানিয়েছে, আদালত অবমানার বিষয়ে যখন তাদের নামে মামলা হয়, তখন থেকেই তারা (দুই মন্ত্রী) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে লবিংয়ের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাদের শিডিউল দেননি। তিনি এটাকে প্রশ্রয় দেননি।
প্রসঙ্গত, গত ৫ মার্চ রাজধানীতে এক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর আপিলের পুনঃশুনানির দাবি তোলেন খাদ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আপিলের শুনানিতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন দলের কাজ নিয়ে প্রধান বিচারপতির অসন্তোষ প্রকাশের মধ্য দিয়ে রায়েরই ইঙ্গিত মিলছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকও প্রধান বিচারপতির মন্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান বলে গণমাধ্যম আসে।
এদিকে তাদের ওই বক্তব্য সে সময় তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। মীর কাসেমের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং বিএনপি নেতারা মন্ত্রীদের বক্তব্যকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘এটা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ।’
অন্যদিকে এ ধরনের মন্তব্য না করতে আহ্বান জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বিতর্কিত বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেন, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কারও মন্তব্য করা উচিৎ নয়।
৮ মার্চ মীর কাসেমের চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আপিল বিভাগের সব বিচারককে নিয়ে বসে দুই মন্ত্রীকে তলব করেন।
দুই মন্ত্রীর দেওয়া যে বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তা বিচার প্রশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ এবং সুপ্রিম কোর্টের সম্মান ও মর্যাদাকে হেয় করার শামিল বিবেচনা করে কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়া হয় তাদের।
ওই বক্তব্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার কার্যক্রম কেন শুরু করা হবে না- তা ১৪ মার্চের মধ্যে জানাতে বলা হয় নোটিসে। সেই সঙ্গে দুই মন্ত্রীকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
আর মীর কাসেমের আপিল মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার আদেশই বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।